নীলক্ষেত মোড়- আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে মিরপুর রোড ধরে কোথাও যাবেন। নীলক্ষেত মোড়ে সিগনালে আটকা পড়লেন। সামনে নিউমার্কেট ১ নং গেট হয়ে বিডিআর (বর্তমানে সীমান্ত রক্ষী) গেট। বামে মোড় নিলে আজিমপুর, ডানে মিরপুর রোড। এটি ঢাকা শহরের একটি ব্যস্ততম ইন্টারসেকশন। প্রচুর গাড়ি আজিমপুর-মিরপুর/গাবতলি রুটে চলাচল করে। এই গাড়িগুলোর প্রিয় জায়গা নীলক্ষেত মোড় ফলে মোড়ের দুইপাশে তাদের গতি খুব কম থাকে। এর মধ্যে নীলক্ষেত মোড় থেকে নিউমার্কেট- ঢাকা কলেজ গেট পর্যন্ত জায়গাটা সবচেয়ে প্রিয় কারণ এখানে চলমান যাত্রীর সংখ্যা অনেক। বিডিআর গেট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কিছু ছোট গাড়ি চলাচল করে তাদেরও প্রিয় জায়গা নীলক্ষেত মোড় থেকে নিউমার্কেট- ঢাকা কলেজ গেট পর্যন্ত।
নীলক্ষেত ও নিউমার্কেট, গাউছিয়া এলাকায় কেনাকাটা করতে আসেন বিপুল এক জনগোষ্ঠী। রাস্তা পার হবার জন্যও এই ইন্টারসেকশনটি জনপ্রিয়। ডানে টার্ন নেওয়ার জন্য সিগনালে অপেক্ষা করে আছেন ৫ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে, আশা ট্রাফিক সিগনাল পেলেই ডানে টার্ন নিয়ে মিরপুর রোডে ঢুকবেন। আপনি বিরক্ত কারণ সামনে একটি রিকশা- আপনি জানেন না সে কি করবে; মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী নামাবে, সোজা যাবে, ইউ টার্ন নেবে নাকি ডানে টার্ন নিয়ে মিরপুর রোডে যাবে। সবাই হর্ন দিচ্ছে তার মানে সিগনাল পরিবর্তন সন্নিকটে। হর্নের তীব্রতায় আপনি বিরক্ত। এর মধ্যেই দেখলেন রিকশাটির সামনের গাড়িটি বামে ইন্ডিকেটর দিচ্ছে- অর্থাৎ সে সোজা বা বামে যাবে। তার মূর্খতার জন্য মনে মনে একটা গালি দিয়ে জোরে দুটা হর্ন দিলেন। হর্নের শব্দে আপনার সামনের রিকশারওয়ালা পেছন ফিরে আপনাকে একটা বাজে গালি দিল। শুনতে না পারলেও বুঝতে পারলেন কি বাজে একটা শব্দ ব্যবহার করল রিকশারওয়ালা । ধৈর্য ধরে বসে আছেন কারণ সিগনাল পড়লেই যেভাবেই হোক এই মোড় পার হতে হবে। কাঙ্ক্ষিত সিগনাল পড়েছে। প্রচন্ড হর্নের শব্দে সবাই ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে। আপনিও হর্ন দিয়ে চলছেন। আপনার গাড়ির সামনে দিয়ে এলোমেলো ভাবে মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে। আপনাকে সাবধান করার জন্য কেউ কেউ আপনার গাড়িতে থাপ্পড় দিয়ে আপনাকে সাবধান করছে। ডানে টার্ন নেবেন এমন সময় দেখলেন সামনের রিকশাটি থেমে গেছে। যাত্রী নামিয়ে এখানেই সে ইউ টার্ন নেবে। আপনার অপেক্ষা করার সময় বা ধৈর্য নেই। জোরে হর্ন সাথে অসভ্য বলে একটা গালিও দিলেন, সাথে সাথে রিকশার যাত্রীও মুখ ঘুরিয়ে মনে হল একই গালি দিল। যা হোক, এই জাতিকে গালি দিয়ে উদ্ধার করতে করতে (এর বিপরীতটাও কিন্তু চলছে যা বুঝতে পারলেও শুনতে পারছেন না কারণ আপনার গাড়িতে এসি চলছে) রিক্সা, মানুষ, গাড়ি পার করে মিরপুর রোডে গাড়ির মাথা ঢুকিয়েছেন কিন্তু এগুতে পারছেন না কারণ সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস একটি বিশেষ কোণে দাড়িয়ে নির্বিঘ্নে যাত্রী তুলছে। আপনার পুনঃ পুনঃ হর্নে বিরক্ত হয়ে আপনাকেই দোষ দিচ্ছে কেন আপনি এই জায়গা দিয়ে পার হয়ে যেতে পারছেন না। এই ঘটনা যখন চলছিলো তখনও কিন্ত আপনার গাড়ির সামনে দিয়ে মানুষের পারাপার চলছে। আপনার গাড়ির অবস্থান ও হর্নে বিশেষ বিরক্ত প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে না তারা। অবশেষে নীলক্ষেত মোড় পেরিয়ে মিরপুর রোডে।
এবার গাড়ি নয়, আপনি রিকশার যাত্রী। একই জায়গা থেকে একই উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। সিগনালে আটকা——-
আপনার এই অভিজ্ঞতা আপনাকে কি শিক্ষা দিল? অসম্ভব একটি দেশে বাস করছেন? এবার রিকশারওয়ালার কাছে, পথচারীদের কাছে, গাড়ির ড্রাইভারের কাছে যাই- মজার ব্যাপার সবাই আপনার মতই ভাবছে। তার অর্থ দাঁড়াল আমরা সবাই নিজের জায়গা থেকে সঠিক আর অন্যের জায়গা থেকে প্রচন্ড রকমের ভুল। নিজেকে সঠিক প্রমাণের জন্য সবসময় ব্যস্ত কিন্তু অন্যকে বিভিন্ন দোষে দুষ্ট প্রমাণ করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।
শেষে, দোষারোপ সংস্কৃতির আরেকটি বাস্তব ঘটনা। ‘ক’ ও ‘খ’একই ধরনের প্রফেশন ও দর্শনে বিশ্বাসী কিন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ব্যক্তি। ‘ক’ একদিন সংবাদ সম্মেলন করে যুক্তি ও বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে প্রমাণ করল যে ‘খ’ একজন ভন্ড ও প্রতারক। পরের দিন খ এর সংবাদ সম্মেলন- বিভিন্ন ঘটনা ও যুক্তি দিয়ে ‘খ’ প্রমাণ করল ‘ক’ একজন ভন্ড ও প্রতারক। সুপ্রিয় পাঠক, আপনারাই নির্ধারণ করেন কে ভন্ড ও প্রতারক?
নীলক্ষেত মোড় যেন গোটা সমাজ ব্যবস্থার চিন্তা ও চেতনার একটি দর্পণ। অন্যকে দোষারোপের মাধ্যমে নিজেকে সঠিক প্রমাণের এই অব্যর্থ চেষ্টা একটি সামাজিক রোগ। আমরা সবাই কি এই নীলক্ষেত সিনড্রোম এ আক্রান্ত?