(এক)
আমি শফিক রায়হান, দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষকতা করছি একটি সরকারি কলেজে। বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক ও ডেপুটেশনে ঢাকার একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের পিএইচডি শিক্ষার্থী।
ব্যক্তিগত জীবনে রায়া আমার একমাত্র মেয়ে, ক্লাস ফাইভে পড়ে। অরিন ফারহানা-আমার স্ত্রী ও প্রাক্তন সহপাঠী- রসায়ন গ্র্যাজুয়েট কিন্তু বর্তমানে মেয়ে আর সংসার নিয়ে সারাদিনই ব্যস্ত। আর সেজন্যই হয়ত আমি অনেকটা সময় আমার মত করে ব্যয় করতে পারি।
চাকুরির পরপরই জাপানের ইয়কোহামাতে পিএইচডি করতে গেলেও একবছর ল্যাঙ্গুয়েজ ও ছয় মাসের রিসার্চ স্টুডেন্টশীপ শেষ হওয়ার পরপরই ছুটিজনিত জটিলতায় দেশে ফিরতে হয়েছিল। জাপানে আর ফেরা হয়নি, হয়নি সে স্বপ্নপূরণ। ফেরার সময় রায়ার বয়স ১০ মাস। এই ব্যর্থতাকে দীর্ঘদিন বহন করলেও রায়াই ছিল জাপানে আমার অবস্থানের একমাত্র অর্জন। সেই না পাওয়া আর প্রচণ্ড ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে পারিনি বলেই এই বয়সে আবার শিক্ষার্থী। অরিনের সাপোর্ট আর আমার প্রচণ্ড ইচ্ছার সমন্বয় হল আমার ছাত্রজীবন।
আমার সুপারভাইজার, বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমেদ কবির। শিক্ষার্থীদের সাথে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হলেও সবাই তাঁকে খুবই ভয় পায়। প্রথম দিকে বুঝতে না পারলেও পরে টের পেলাম ভদ্রলোকের মেজাজের নিয়ন্ত্রণ সবসময় তাঁর উপর থাকে না। কোয়ান্টাম কণার মত তাঁর মুড বোঝা কঠিন। তবে ভদ্রলোক ভাল মুডে থাকলে টানা অনেক কথা বলতে পারেন এবং প্রচণ্ড হিপ্নোটাইজিং ক্ষমতা আছে তাঁর মধ্যে। রসায়ন, জীবনবোধ, রাজনীতি, সবকিছুতে তাঁর নিজস্ব চিন্তাগুলো যে কাউকেই মুগ্ধ করে রাখবে। শুনেছি ক্লাসে উনি খুব জনপ্রিয়। বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর ওনার পরামর্শেই ৯ ক্রেডিট থিওরি কোর্সের সবটাই সম্পন্ন করলেও স্যারের কোনো ক্লাস পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। সুযোগ না হলেও ক্লাসে ওনার জনপ্রিয়তার কারণ বুঝতে আমার সমস্যা হয়নি। রসায়নের মত একটি বিষয়কে গল্পের মাধ্যমে এত উপভোগ্য করা যায় ওনার সাথে কাজ করার সুযোগ না পেলে বুঝতেই পারতাম না।
একজন শিক্ষক হিসেবে আমারও কিছু নিজস্ব স্টাইল আছে এবং তা নিয়েই আমি আমার মহলে কিছুটা হলেও জনপ্রিয়। কিন্তু অধ্যাপক ড. আহমেদ কবির স্যারের সাথে বিভিন্ন সময়ে গল্প করার পর আমি আমার নিজের সম্পর্কে আগের ধারণা নিয়ে লজ্জিত। একজন সাহিত্যিক যেমন বৃষ্টিতে ভিজে রোমান্টিক হয়ে গল্প বানাতে পারেন কবির স্যার তেমনি বৃষ্টিতে ভিজে রসায়নের গল্প বলতে পারেন, ভাবাতে ও শেখাতে পারেন, পারেন অনেক দূর চিন্তা করাতে। অন্য মানুষের সাথে মানসিক সংযোগ স্থাপন করার এক আশ্চার্য ক্ষমতার অধিকারী তিনি। তাঁর মতে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সাথে মানসিক সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমেই একজন মানুষ শিক্ষক হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন।
উনি আমার সাথে গল্প করতে পছন্দ করেন কারণটা আমি জানি এবং মনে হয় উনিও জানেন। শিক্ষক হিসাবে আমাদের দুজনের দর্শনে মিল অনেক। ওনার মত অন্যের সাথে মানসিক সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা না থাকলেও আমার প্রিয় বিষয় মনোবিজ্ঞান। শিক্ষা, গবেষণা, জীবনবোধ বিভিন্ন বিষয় তাঁর সাথে আলোচনা হত বিভিন্ন সময়ে। ওনার সাথে প্রথম কিছুদিন গবেষণা কাজ নিয়ে কথা বলার পর আশ্চর্যজনক ভাবে আমি লক্ষ করলাম অনেক পুরানা একটা গবেষণা চিন্তা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে- আর তা হল অন্যের সাথে মানসিক সংযোগ স্থাপনের একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি। হঠাৎ করে এই বিষয়টি একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠতে থাকল। কবির স্যারের ভাবনা গুলো আমার উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে।
(দুই)
নভেম্বর মাস। ২৮ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত স্যার দেশের বাইরে থাকবেন। সপ্তাহের ছুটি সহ বাকি আরো দুই দিন। স্যার সবাইকে ছুটি দিয়ে দিলেন এই চারদিনের। এমন কয়েকদিনের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম কয়েকমাস থেকে। স্যারের কাছ থেকে এই কয়েকদিন ল্যাবে কাজ করার বিশেষ অনুমতি নিয়ে রাখলাম।
পর পর চারদিন ছুটি, বিশেষ অনুমতি নিয়েছি আমার গোপন মিশন চালানোর জন্য। প্রায় তিন বছর হয়ে গেল, স্যারের চাহিদা মোতাবেক ভালো কিছু কাজ হয়েছে। স্যার বেশ খুশি আমার কাজে। আমার গবেষণা, পাবলিকেশন, সুপারভাইজারকে খুশি রাখা-সবই হয়েছে আমার মূল কাজের শাখা প্রশাখা থেকে। সাথে আমার গোপন গবেষণা মিশনও পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে নিয়েছি নিজের মত করে। শেষ কয়েক মাসে আমার পরিকল্পনা মোতাবেক সবই গুছিয়ে নিয়েছি। এই ছুটি এবং কাজ করার অনুমতি আমার খুবই দরকার ছিল। ২৮, ২৯ তারিখ, ল্যাবে আগামী চারদিনের কাজের প্রায় বাকিটাও গুছিয়ে নিলাম।
আজ নভেম্বরের ৩০ তারিখ। ল্যাবের সব প্রস্তুতি একবার চেক করে বাসায় ফিরলাম।
রায়া দরজা খুলে দিল। গন্ধে মনে হল বিশেষ খাবারের আয়োজন চলছে।
কি ব্যাপার মা? বিশেষ কিছু রান্না হচ্ছে মনে হয়। কেউ এসেছে? মা কই?
রান্না ঘরে উঁকি দিলাম।
কি ব্যাপার অনেক আয়োজন?
অরিনের স্বভাব সুলভ হাসি।
চা খাবে?
পেলে ভালোই হয়।
শোন, আমি জরুরি কিছু এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য কাল সিলেট যাব। দুই তারিখ ফিরব।
মিথ্যা কথা বলতে যেন আস্বস্তি লাগল। অরিন কয়েক মুহূর্তে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ঠিক আছে। তুমি ফ্রেশ হও চা দিচ্ছি।
রাতের খাবারের জন্য ডাইনিং টেবিলে ডাক পড়ায় গিয়ে দেখি অনেক আয়োজন। মেয়ের পছন্দের পোলাও, মুরগির রোস্ট। আমার পছন্দের চিংড়ি দিয়ে করলা, আলু ভর্তা, ইলিশ ভাজি, গরুর মাংস। অনেক ক্ষুধার্ত কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে খাবার শেষ করলাম।
আজ কি কোনো বিশেষ দিন? অরিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
না, রায়া খেতে চাইল তাই। অরিনের উত্তর।
কয়েকবার আড়চোখে তাকালাম অরিনের দিকে, আয়োজনের কারণ উদঘাটনের জন্য, কিন্তু প্রতিবারই চোখাচোখি হতেই অস্বস্তি আরো বাড়ল।
মোবাইল হাতে বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কবির স্যারের সাথে প্রথম এক মাসের মিটিং এর আলোচনা, শেষ তিন বছরের মুল গবেষণার পাশাপাশি আমার গোপন মিশন-গোটাটাই একবার রিভিউ করে নিলাম।
প্রায় তিন বছর আগের কথা। স্যারের সাথে দ্বিতীয় মিটিং। কবির স্যার বলতে শুরু করলেন। সেলুলোজের বিল্ডিং ব্লক গ্লুকোজ ইউনিট। এখানে সোডিয়াম মেটা পার আয়োডেট দিয়ে গ্লুকোজ ইউনিটের ২ ও ৩ নং কার্বনে কার্বক্সিলিক গ্রুপ ঢুকানো সম্ভব। মজার ব্যাপার হল এই গ্রুপে কাউন্টার আয়ন হিসেবে থাকবে সোডিয়াম। ফলে সেলুলোজ পলিমার হলেও তাড়িৎ বিশ্লেয্য পদার্থ হিসাবে কাজ করবে। কার্বক্সিলিক গ্রুপ খুবই সক্রিয় হওয়ার সহজেই বিভিন্ন কার্যকরী গ্রুপ ঢুকানো যেতে পারে। আর এভাবেই সেলূলোজ কে জীবন দেয়া সম্ভব। যেমন, কার্বক্সিলিক গ্রুপ থাকার কারণে এটি pH অর্থাৎ হাইড্রোজেন আয়ন সংবেদনশীল হবে। pH ৬ এর উপর এটি আয়নিত থাকবে ফলে বিভিন্ন ধাতব আয়ন, যেমন ক্যালসিয়াম এর সাথে সহজেই গ্রুপগুলোর কোঅর্ডিনেট বন্ধন তৈরি করতে পারবে এবং এটি দুর্বল জেল এ পরিণত হবে। ম্যাকানিক্যাল শক্তি বাড়ানোর জন্য এই জেলের কার্বক্সিলিক গ্রুপে দ্বিবন্ধন সংযোগের মাধ্যমে এটিতে ডাবল নেটওয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব। এটি সম্ভব হলে এই জেল বায়োকম্পাটিবল হবে, সেলফ হিলিং ধর্মের অধিকারী হবে ফলে ভবিষ্যতে হয়ত সেলুলোজ থেকে তৈরি ম্যাটেরিয়াল আর্টিফিসিয়াল টিস্যু হিসাবে ব্যবহার করা যবে। স্যার বলেই যাচ্ছেন কীভাবে এতে এন্টিব্যাক্টেরিয়াল ধর্ম আনা সম্ভব এবং আরোও অনেক কিছু। কিন্তু আমি আটকে আছি সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, সেলফ হিলিং, বায়োকম্পাটিবিলিটি নিয়ে।
সাদা কাগজে কাজের পরিকল্পনা আর রাসায়নিক ফর্মুলায় কাগজ হিজিবিজি হয়ে উঠছে। উত্তেজিত কবির স্যার হঠাৎ বলে উঠলেন তুমি মনে হয় ক্লান্ত, আজকে থাকুক- পড়তে থাক পরের সপ্তাহে আবার বসব।
স্যারের রুম থেকে বের হয়ে ল্যাবে গিয়ে বসেছিলাম। সবাই চলে গেছে। মাথার ডান পাশটা দপদপ করে ব্যথা করছে। খুবই ক্লান্ত লাগছে। মাথার মধ্যে ঘুরছিল সেলুলোজ হাইড্রোজেল, সেলফ হিলিং, pH সংবেদনশীলতা এবং সাথে যুক্ত হল অ্যাকশান পটেনশিয়াল, ভোল্টেজ-গেটেড সোডিয়াম চ্যানেল, ভোল্টেজ-গেটেড ক্যালসিয়াম চ্যানেল, ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস—
ভাবনায় ছেদ পড়ল অরিনের কথায়
পান খাবে?
পান পেলে কোথায়?
অফিসের একটা প্রোগ্রাম ছিল।
খুব টায়ার্ড লাগছে।
মশারি লাগিয়ে দেব?
আমার পুরানা অস্বস্তিটা বেড়ে গেল অনেক গুন। মশারি টাঙানো নিয়ে কত ঝগড়া।
না ঠিক আছে, আমি খাটিয়ে নেব।
কাল কখন বের হবে। রায়াকে টিচারের কাছে দিয়ে যেতে পারবে?
ঠিক আছে। রায়াকে টিচারের কাছে দিয়ে ল্যাবে যাব। তারপর বিকালের বাসে সিলেট।
অরিন চলে গেলে দ্রুত হ্যাবারসেক গুছিয়ে রাখলাম।
বিছানায়, ক্লান্ত কিন্তু ঘুম আসছে না। মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছি। মাথা থেকে সব বের করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি।
গত তিন বছর পিএইচডির মূল কাজের বাইরে অনেক কিছুই শিখতে হয়েছে। ইলেক্ট্রক্যামিকেল সেন্সিং এর উপর পড়াশোনা এবং হাইড্রোজেলের পাতলা স্তরের দুই পাশে কন্ডাক্টর দিয়ে দ্রবনের ঘনমাত্রা, pH, ইত্যাদির প্রভাবে উৎপন্ন বিভবকে বহুগুনে বর্ধিত করে তা পরিমাপ করা, মেশিন লার্নিং ও প্রয়োজনীয় প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ, লোকাল এনেস্থেশিয়া আরও অনেক কিছু।
ভাবনায় আবার ছেদ পড়ল অরিনের কথায়
ঘুমাওনি।
ঘুম আসছে না।
একটা ট্যাবলেট খেয়ে নাও।
হুম।
অরিন কি কিছু বলতে চাচ্ছে?
(তিন)
সবকিছু তৈরি। কম্পিউটারে প্রয়োজনীয় সব সফটওয়্যার চেক করে নিলাম। লোকাল এনেস্থেশিয়ার জ্ঞান দিয়ে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করলাম। আঙ্গুলে সেন্স চলে যাবার পর আঙ্গুলের মাঝ বরাবর এক বর্গ সেমি জায়গা থেকে নখ তুলে ফেললাম। ধারণার ছেয়ে বেশি ব্লিডিং হচ্ছে। খুব দ্রুত সবকিছু করতে হবে। নখের ফাঁকা অংশে পূর্বে তৈরি ডিভাইসটি বসিয়ে দিলাম দ্রুত। প্লাটিনাম তার দুটো নখের উঠানো অংশে ফুটো করে বাইরে এনে দ্রুত কাটা নখটি বসিয়ে দিলাম আগের জায়গায়। চেপে ধরলাম জোড়ে রক্ত বন্ধ করার জন্য। প্লাটিনাম তার দুটো নখের গোল্ড প্রিন্টেড অংশে আটকিয়ে দিলাম সিলভার পেস্ট দিয়ে। নখের প্রিন্টেড অংশ বাদে বাকি জায়গা ভাল করে বিশেষ ব্যান্ডেজ দিয়ে আটকিয়ে দিলাম।
আমার আগের পরীক্ষালন্ধ জ্ঞান ও পরিকল্পনা সঠিক হলে দুই ঘণ্টার মধ্যে নখ ও শরীরের সেলের সাথে সেলফ হিলিং এর মাধ্যমে আমার তৈরি বিশেষ এই হাইড্রোজেল বিশিষ্ট ডিভাইস সংযুক্ত হবে আমার নিজের শরীরের সাথে। আমার চিন্তাগুলো ডিভাইসের মাধ্যমে সিগন্যাল দেবে আমার বিশেষ কম্পিউটার ইন্টারফেসে। তারপর আমার চিন্তা ও আউটপুট ভোল্টেজের কোরিলেশন।
প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে পেইন কিলার খেয়ে নিলাম। ২ ঘণ্টা পর নিজেকে কানেক্ট করে নেব কম্পিউটারের সাথে। ব্যথা অনেকটা কমে এসেছে। অপেক্ষা করছি। মাথাটা প্রচণ্ড দপদপ করছে, গলা শুকিয়ে আসছে। টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে নিলাম। আর এক ঘণ্টা। আরো একবার সবকিছু চেক করে নিলাম। পরবর্তী সময়গুলো খুবই জরুরি। ক্লান্ত লাগছে, মাথা ব্যথাটা বাড়তে থাকায় বিরক্তবোধ করছি।
বাবা….
রায়ার গলা না?
মেয়েটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। মনে হয়, এইতো সেদিন বিকাল ৪:৩৫ মিনিট একটা জীবন্ত পুতুলের জন্ম। আগের রাতে জাপানের ইয়োকোহামা শহরের বাসায় আরিন আর আমার নির্ঘুম এক রাত। অরিনের অস্বস্তি, সারারাত পায়চারি করেই কাটিয়ে দিলাম দু’জনে। অস্বস্তি রাড়তে থাকায় সকালেই ক্লিনিকে চলে গেলাম প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে। ক্লিনিকে ভর্তি। তারপর ডাক্তারের প্রাথমিক চেকআপ। অতঃপর একটু স্বস্তি। সবই ঠিক আছে। হসপিটালে ভর্তি করে কেবিনে ট্রান্সফার করে দিল, সাথে চলছে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি।
স্বস্তি টিকল না বেশিক্ষণ। অরিনের পেইন বাড়ছে। বাড়ছে তার অস্বস্তি, আস্তে আস্তে তা পরিণত হল তীব্র এক পেরিওডিক ব্যথায়। একটু চুপ থাকলেও আবার ব্যথায় কুকিয়ে উঠছে। ডাক্তারের আবার দেখে গেলেন। সব ঠিক আছে। নরমাল ডেলিভারি হবে। আরো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ব্যথায় অস্থির অরিনের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। এর মধ্যেই আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই রাশিক সস্ত্রীক হসপিটালে আমাদের সহযোগিতার জন্য হাজির। বৃষ্টি, রাশিকের স্ত্রী, ভাল জাপানিজ জানে। আলোচনা করে ঠিক করলাম ডাক্তারের সাথে কথা বলে অপারেশন করবার অনুরোধে করব। আলোচনার ফলাফল শূন্য, ডাক্তার কোন ভাবেই কনভিন্সন্ড না। সব কিছুই ঠিক আছে। আমাদের নরমাল ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই কথা শোনার পর অরিন আমাকে বাংলায় যে গালি দিল, তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই সম্ভব। আমাকে সামনে দেখলেই মধুর সব গালি নির্গত করছে। ডাক্তারকে কনভিন্স করতে না পারার ব্যর্থতা মাথায় করে একটু দুরে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে আবার গেলাম ডাক্তারের কাছে। সাহায্যে নিলাম বৃষ্টির কাছ থেকে। বেলা ১:৩০, ডাক্তার আবার ভিজিট করে সিদ্ধান্ত দিলেন। একটা ইঞ্জেকশন দেবে পেইন বাড়ানোর জন্য। ৩ টার মধ্যে নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রয়োজনীয় অবস্থা তৈরি না হলে ৩:৩০ এ অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হবে। আধা ঘণ্টা পর ইঞ্জেকশনের ফলাফল আমি নিজেই দেখতে পেলাম। অসহ্য অবর্ণনীয় এক যন্ত্রণায় ছটফট করছে অরিন। অসহায় আমি বার বার ওর হাত চেপে ধরছি।
জাপানের নিয়ম অনুযায়ী হাসব্যান্ড লেবার রুমে থাকতে পারে এবং অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে হাসব্যান্ডকে থাকতে উৎসাহিত করা হয়। দুজন ডাক্তার, নার্স, অরিন ও আমি। সেদিন লেবার রুমে না থাকলে একজন মানুষের জন্ম প্রক্রিয়া এতটাই জটিল এটা আমার কোনদিনই জানা হত না। অস্থির এক যন্ত্রণায় ছটফট করা অরিনের সেই মুহুর্তগুলো যেন অনেক দীর্ঘ এক সময়। জাপান সময় ৪:৩৫ মিনিট, পৃথিবীতে আগমন আমাদের দুজনের নতুন রূপ। অরিন অনেক কষ্টে চোখ মেলে দেখছে, ব্যথায় বিবর্ণ মুখটি ব্যথা আনন্দের এক নতুন রূপে আবির্ভূত। আমি তাকিয়ে আছি সদ্য জন্ম নেয়া রায়ার দিকে, দু-চোখ ভিজে উঠছে, চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। ডাক্তাররা বারবার বলছে ওমেদেতো (অভিনন্দন)। একবার রায়ার দিকে আর একবার অরিনের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ঢাকার চেষ্টা করছি কিন্তু আমার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আরিনের দিকে তাকিয়ে মনে হল ওকে ঝাপসা দেখছি।
কে এটা?
এটাতো অরিন? না। তবে…।
অরিনের মুখে আমার মায়ের মুখের প্রতিচ্ছবি। আমি যেন রায়াতে পরিণত হলাম। মায়ের জন্য প্রচণ্ড এক কষ্টে চোখ বার বার ভিজে উঠছে।
(চার)
আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। কম্পিউটার ইন্টারফেস আবার চেক করে নিলাম। ২০ মিনিট পরই আমাকে কানেক্ট করব কম্পিউটারের সাথে। মাথাটা প্রচণ্ড দপ ধপ করছে। একটা ভোঁতা ব্যথা। ঠিকমতো চিন্তা করতে পারছি না। গলাটা প্রচণ্ড শুকিয়ে আসছে। হাতের কাছেই পানির বোতল। শরীরে অসাড় অনুভূতি মনে হল হাত দিয়ে পানির বোতলের ধরার ক্ষমতা আমার নেই তারপরও কষ্ট করে পানের বোতলটা কাছে নিয়ে একটু পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। আর মাত্র পাঁচ মিনিট। আমাকে কানেক্ট করব কম্পিউটারের সাথে এবং আমার পরিকল্পনা যদি সঠিক থাকে আজকে এবং আগামীকাল আমার লিখিত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী ব্রেইনের জানা চিন্তাগুলোর সাথে কম্পিউটারকে ট্রেইন করবো। এইভাবে আগামী দু’দিন চলবে এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ট্রেইনিং। প্রাথমিক পরীক্ষা সফল হলে পরবর্তী প্রস্তুতি।
কি ব্যাপার?
হঠাৎ অরিনের গলা, হ্যালুসিনেশন? অরিনের গলা শুনতে পাচ্ছি কেন? এই মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রথম থেকেই। দীর্ঘদিন একসাথে একই ক্লাসে পড়াশোনা করলেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে ওঠে একদম শেষের দিকে। কোনোদিন লাইব্রেরির পেছনে চায়ের দোকান, কোনোদিন হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি-ফুলার রোড-কার্জন হল-টিএসসি। সাহিত্য, জীবনবোধ থেকে শুরু করে অপ্রয়োজনীয় কত কথা। একই দিন একই পথে একবার দুইবার তিনবার পর্যন্ত হেঁটেছি। এই চলতে চলতেই একসময় আবিষ্কার করলাম আমরা দুজন দুজনের প্রতি মানসিকভাবে ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেছি। আমাদের পরাজয়ের শুরু নিজেদের কাছে। আমরা হারলাম দু’জন দুজনের কাছে আমাদের সবকিছু নিয়ে এবং সেখান থেকে আমাদের গল্প আমাদের নতুন অনুভূতির শুরু।
ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজে উঠলো। কাঙ্ক্ষিত সময়। আমাকে কানেক্ট করলাম কম্পিউটারের সাথে। হিজিবিজি সিগন্যাল প্যাটার্নে স্ক্রিন ভরে উঠলো। এবার মাথা ঠান্ডা করে আস্তে আস্তে আমাকে কম্পিউটারকে ট্রেইন করতে হবে আমার স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী। শুরু করলাম। স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী চিন্তা করছি আর ফলো করছি সিগন্যাল প্যাটার্ন। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলো। আমি স্ক্রিপ্ট দেখে চিন্তা করছি আর আমার জানার কথাগুলো একটা স্ক্রিনে একটা প্যাটার্ন তৈরি করছে। এভাবেই চলতে থাকছে, কিন্তু মনে হল আবার শরীর কোথায় যেন আমাকে সাপোর্ট করছে না। আমি উঠে বসার চেষ্টা করছি কিন্তু উঠতে পারছি না। প্রচণ্ড পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। মাথা দপদপ করছে। হাত দিয়ে পানির বোতল নেয়ার চেষ্টা করলাম মনে হচ্ছে সেটাও আমার হাতের নাগালের বাইরে। অনেক কষ্ট করে একটু পানি খেলাম। একটু উঠে বসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম, চেয়ারের একদিকে বেশি ঝুঁকে গেছি। সোজা হওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ। গোটা শরীর স্টিফ হয়ে যাচ্ছে আমি নড়তে পারছি না। আমি কি চিন্তা করতে পারছি?
মনে হচ্ছে আমার চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আমি যা ভাবতে চাচ্ছি তা ভাবতে পারছি না। কম্পিউটার স্ক্রিন হিজিবিজি সব প্যাটার্নে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ভয়ে শরীর শিউরে উঠল।
তার মানে আমি কি কম্পিউটার দখলে চলে যাচ্ছি? আমার সমস্ত চিন্তা কি কম্পিউটার কন্ট্রোল করছে?
আমি নিজের মতো করে ভাবতে পারছি না, সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করছি কিন্তু নড়তে পারছি না, হাত নাড়ানোর চেষ্টা করছি কিন্তু হাত নড়তে পারছি না। প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে থাকলাম। যতটুকু চিন্তা কাজ করছে তাতে দ্রুত নিজেকে কম্পিউটার থেকে ডিসকানেক্ট করতে হবে। কিন্তু হাত নড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। গোটা শরীর অসার আসছে। একদিকে হেলে পড়ছি চেয়ারে। হঠাৎ করে চেয়ারে খট করে একটু শব্দ হলো চেয়ারের একটি পা কি স্লিপ করল? চেয়ার কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে সাথে আমিও। প্রচণ্ড শক্তি সঞ্চয় করে টেবিল ধরার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। চেয়ার উল্টে গেছে। আমি কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছি। কম্পিউটার বিফ বিফ সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে। শূন্যে ভাসমান আমি। নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেও কোন কিছু করতে পারলাম না। হঠাৎ করে মনে হল কেউ যেন আমাকে ধরে ফেলল শক্ত হাতে আমাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে কিন্তু আমার ভার বহন করতে না পেরে আমার দিকেই ঝুঁকে পড়ছে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখিয়ে আমার দু’হাত ধরে আমাকে ঝাঁকাচ্ছে অরিন। কি খারাপ স্বপ্ন দেখছ?
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি ওর মুখের দিকে। প্রচণ্ড এক ভালোলাগা আর আসীম মায়ার বাঁধনে আটকে থাকা অরিনের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি আর বিড় বিড় করছি।
থাক। আর ঢং করতে হবে না, ওঠো। আজকে বিশেষ দিনে আমরা একসাথে নাস্তা করব। রাস্তা রেডি।
তাইতো, আজকে পয়লা ডিসেম্বর, আমাদের অনুভব আর অনুভূতি গুলো নিয়ে পথ চলার আরোও এক বছর পূর্ণ হল। আমাদের এই অনুভবের অব্যয় বেঁচে থাকুক আমাদের বিলীনতার মাঝেও।
মো. শাখাওয়াৎ হোসেন ফিরোজ
বুয়েট ক্যাম্পাস, ১ ডিসেম্বর, ২০২৪